শনিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১২

ভালবাসা যে শুধুই ভালবাসা

বলো!! আর কোন দিন সিগারেট খাবে না!! -খাব না অন্য কোন মেয়ের দিকে তাকাবে না!! -না প্রমিজ কর আমাকে! -করলাম!! এভাবেই স্বপ্না আমাকে বলেছিল সে আমাকে ভালবাসে। স্যরি, আসলে ওর কথায় আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ও আমাকে ভালবাসে। কখনও ভাবিনি যে কেউ কখনও আমাকে ভালবাসবে। ছোটবেলায় বাংলা সিনেমা দেখে ভাবতাম প্রেমে কত মজা! নায়ক-নায়িকা নেচে-গেয়ে প্রেম নিবেদন করে। আমার কাছে তখন মনে হত প্রেম নিবেদন করতে হলে নাচ জানতে হবে। স্কুলের অনেক মেয়েকেই মনের আয়নায় চুপিচুপি উকি দিয়ে যেতে দেখতাম। কিন্তু বোকা আমি নাচ জানতাম না বলে প্রেমও নিবেদন করতে পারতাম না। যাক সেসব কথা, স্কুল পার করে কলেজে ভর্তি হলাম। পড়া-শুনার চাপে প্রেম-ভালবাসার কথা মাথায় আসত না। যান্ত্রিক জীবনে মনটাও আমার মেশিন হয়ে গিয়েছিল। কলেজ পার করে ভর্তি হলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। নতুন বন্ধু পেলাম কিছু। আনন্দ, নাফি, সুমন, শান্তা, স্বপ্না- বেশ মজা করতাম বন্ধুরা মিলে। একদিন হঠাৎ সুমন প্রস্তাব দিল বাংলা সিনেমা দেখার। বাংলা সিনেমার নাম শুনে নাক সিটকালেও বাকি সবাই দেখলাম বেশ উৎসাহে সায় দিল। আমাদের বাংলা সিনেমাগুলো শিল্পমান হারালেও বিনোদন শিল্পগুণে সেগুলো যে কতটা অনন্য সেটা আমি বুঝতে পারলাম। এরপর দিব্যি করেছিলাম যে মন খারাপ হলেই বাংলা সিনেমা দেখতে যাব। যে সিনেমা রম্যগুণে( হোক টা নিম্নমান ) বোবাকেও হাসাতে পারে সেখানে আমি তো ছাই। এবার সিনেমার কাহিনীতে আসি। সিনেমার নায়ক আলম খান বুয়েটের স্টুডেন্ট। সে ভ্যানে চড়ে গ্রামে যাচ্ছে বন্ধুর বিয়েতে। রাস্তার পাশে হঠাৎ নায়িকাকে দেখে তাঁর চোখ আটকে যায়। নায়িকা আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আর ওপর থেকে বৃষ্টির মতো ফুলের পাপড়ি ঝরে পড়তে থাকে নায়িকার শরীরে। আমগাছে থেকেও যে গোলাপের পাপড়ি ঝড়ে সেটা মহান সৃষ্টিকর্তার কতবড় নিয়ামত হতে পারে, আমার এই সিনেমা না দেখলে জানাই হত না! হয়তবা নায়কের চোখের জাদুতে আমগাছ থেকে গোলাপ ঝরতে পারে, সে কার্যকরণ বাদ রেখেই দেখতে থাকলাম। বন্ধুর বিয়েতে গিয়ে আলম নিজের বিয়ের বীজ বুনে এল। বিধাতার কি কৃপা!! স্যরি, বাংলা সিনেমার স্বভাবজাত চমৎকারি হবে এটা- শহরে ফিরে আলম জানতে পারল নায়িকাও বুয়েটের স্টুডেন্ট। এরপর সেই নাচ-গান-প্রেম-মারামারি এবং অবশেষে নায়িকার সাথে নায়কের শুভ মিলন। সিনেমা হল থেকে বের হয়ে স্বপ্নার চোখে কেমন যেন মায়া অনুভব করতে পারলাম। আমার হৃদয়ের অভিশপ্ত আয়নাতে কি স্বপ্না উকি দিয়ে গেল, টের পেলাম না একদমই!! এরপর অনেকদিন চলে গেল। সময়ের অন্তর্জালে আমিও ভুলে গেলাম সে অসামান্যতায় সামান্য অনুভবের কথা। এর মাঝে একদিন ক্যাম্পাসে সুমন, নাফি, শান্তা কিংবা আনন্দ কারও দেখা পেলাম না। ক্যান্টিনে যাবার সময়ই স্বপ্নার সাথে দেখা। শীতবুড়ির জীর্ণতায় বিবর্ণ শিমুল গাছের নিচে দাড়িয়ে ও আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল অপলক। ওর কাছে গিয়ে দাড়াতেই ঝরঝরে এক পশলা বৃষ্টি অনেকটা উড়ে এসে জুরে বসল। দৌড়ে গিয়ে ক্যানটিনের বারান্দায় দাড়ালাম আর মেঘরাজ বিদায় নিল তখনই। সাদা রবির স্নিগ্ধ আলোয় জলে ভেজা শিমুল গাছটিকে যেন মুক্তো জড়ানো কোন অভিমানী পরীর মত লাগছিল। বুঝতে পারছিলাম মনের কোণে লুকিয়ে থাকা অনুভূতির চরকার সূতোয় কে যেন টান দিয়েছে। নইলে শিমুল গাছকে এই জীবনে আমার কখনও পরী মনে হয়নি, আজ কেন মনে হল? স্বপ্নার সাথে সেদিন অনেকক্ষণ গল্প করেছিলাম। বন্ধুর সাথে আড্ডা হয় কিন্তু গল্প হয় না কিংবা আড্ডাটাকে সেদিন গল্প মনে হয়েছিল সুপ্ত অনুভূতির হঠাৎ জাগরণের জন্য। স্বপ্নার প্রতি কেমন যেন একটা হৃদয় নিংড়ানো আবেগ আমাকে বিমোহিত করছিল প্রতিনিয়তই। কিন্তু সেটা ওকে বুঝতে দিতে চাইত না মন কিংবা নাচতে জানি না বলে ছোটবেলার সে যুক্তিহীন ভয়ে জর্জরিত ছিল সে। তবুও স্বপ্না বুঝতে পেরেছিল আমার মনকে। ভালবাসার মানুষের মনের কথা বুঝি বুঝা যায়। আমি সিগারেট খেতাম, সুন্দরী মেয়ে দেখলেই তাকাতাম শুধু কিউরিসিটির জন্যই কিংবা অলস মন এসব অকাজেই মজা খুজে পেত। তাই স্বপ্না যেদিন আমাকে প্রমিজ করালো সেদিনই আমি নিশ্চিৎ হলাম ও আমাকে ভালবাসে। আজ বারই জানুয়ারি। চার বছর আগের ঠিক এই দিনেই ওকে আমি প্রপোজ করেছিলাম। প্রপোজ করার কূটবুদ্ধিটা মাথায় এসেছিল অনেকটা হঠাৎ করেই। সেদিন ছিল হরতাল। ভার্সিটি যাওয়া হয়নি। স্বপ্নাকে ফোনে বলে দিলাম বিকালে দেখা করব। এর আগে কখনও আমরা দুই জন একাকী দেখা করিনি, তাই স্বপ্না হয়ত কিছুটা হলেও আন্তাজ করতে পেরেছিল আমি কেন ওকে ডাকলাম। একটু তাড়াতাড়িই বের হলাম, কারণ ফুল কিনতে হবে। কিন্তু নাহ… বেশিরভাগ ফুলের দোকান বন্ধ! আধখোলা কয়েকটা ফুলের দোকান ঘুরেও মনের মত ফুল পেলাম না। রাস্তায় ফুল হাতে ছুটে আসা পিচ্চি টোকাইও সেদিন ফুলের সন্ধান দিতে পারেনি। সারা দুপুর সব দোকান তন্ন তন্ন করে ফেলেও কিছু পেলাম না। অবশেষে পথে চলতে চলতেই দেখলাম একটি পথশিশু কয়েকটা কাঠগোলাপ ছিড়ে ছিড়ে পথে ফেলছে। দৌড়ে গেলাম ছেলেটার কাছে। কিন্তু ওর হাতে অবশিষ্ট ছিল একটা আধা ছেড়া ফুল। জিজ্ঞাসা করলাম, ফুলগাছ কোথায়? প্রত্তুতরে ছেলেটা জানাল, "সামনেই" ছেলেটাকে সাথে নিয়েই খুঁজে বের করলো কাঠগোলাপ গাছ। প্রস্ফুটিত কিছু ফুল দেখে অনেক খুশি হয়েছিলাম তখন। এরপর শুরু হল আসল পরীক্ষা। গাছে উঠতে পারিনা আমি। আশেপাশে তেমন কাউকে পেলাম না। কিন্তু ফুল তো আমার লাগবেই। ঈশ্বরের নাম জপে কোনরকমে বহু কসরত করে কিছুদূর উঠলাম। হাতের নাগালেই বেশ কয়েকটা ফুল পেয়ে সেগুলো বুটিয়ে নিলাম। ফুলগুলো একত্র করে শুরু করলাম আবার পথচলা। এভাবেই পৌঁছলাম গন্তব্যে। তখন সন্ধ্যা। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না কিভাবে দিবে ফুলগুলো ওকে। ততক্ষণে ফুলগুলো অনেকটা মিইয়ে গেছে। আর দেরি না করে মন মানুষটিকে ডাক দিয়ে হাতে ধরিয়ে দিলাম ফুলগুলো। কিভাবে দিতে হয় আমি বুঝিনি। অসার মস্তিষ্কের পাগলামির এই অঘোষিত প্রচেষ্টা পরিণতি পেল। স্বপ্নার মুখে এক ঝলক হাসির দেখা পেলাম। স্বপ্না বলল, “আমাকে কেউ কখনও কাঠগোলাপ দেয়নি” আমার মনে ভালবাসার অনুভবগুলো সে অভিশপ্ত আয়নাকে ভেংগে দিয়ে দিয়ে সজোরে বয়ে গেল। মনে হল, তাকে পেয়েছি, আর কিছু চাইনা জীবনে। নাচতে না পারার লজ্জা ভুলে সেদিন বলেই দিয়েছিলাম ভালবাসি। স্বপ্না শুধু মিটিমিটি হেসেছিল, কোন কথা বলেনি। দুপুর-বিকালের "সার্চ-দ্য খোজ ফর কাঠগোলাপ" অভিযানের সমাপ্তি ঘটিয়ে এক সুখী মানুষের তৃপ্ত হৃদয় নিয়ে ঘরে ফিরলাম। সেদিনের পর থেকে আমরা দু’জন একসাথে কত ঘুরেছি শহরময়। কখনওবা সবার চোখ ফাকি দিয়ে হারিয়ে যেতাম নির্জন সবুজের মায়ায়। আমার কর্কশ কন্ঠে বনলতার অসামান্য কবিতাগুলো তাকে আবৃত্তি করে শুনানোর পালা শুরু হয়ে আর শেষ হতেই চাইত না। কিংবা শরতের বিকেলে আমরা দু’জন হারিয়ে যেতাম নীল আকাশ আর সাদা কাশফুলের অরণ্যে। স্বপ্নাই প্রথম আমাকে বৃষ্টির রুপ দেখিয়েছিল। বৃষ্টিতে আমার ভিজতে না চাওয়া, ওর ভিজতে চাওয়ায় ইচ্ছার কাছে বাধভাংগা স্রোতের মতই ভেসে যেত। কোকিলের কালোয় কি পরিমাণ সৌন্দর্য লেগে আছে সেটা আমি তাকে ভালোবাসার পরই প্রথম দেখেছিলাম। তার ভালোবাসার স্পর্শে পেয়ে আমার বিমুদ্ধ নয়ন পৃথিবীর সব রং দেখতে পেল। কিন্তু স্বপ্নের সব রং ধীরে ধীরে ক্ষসে পড়তে লাগল। দীর্ঘ তিন বছরের সম্পর্ক এক সময় কেন যেন উপেক্ষা করতে লাগলাম। স্বপ্নার ফোনও আমার নিকট বিরক্তির কারণ হয়ে দাড়ালো। কোন এক অজ্ঞাত কারণে তাকে আমার অসহ্য লাগতে লাগল। আর আমার উপেক্ষাকে সে আপন করে আমাকে পর করে দিল। এখন বৃষ্টি হলে আমি কাদি তাকে মনে করে। বৃষ্টি এখন আর আমাকে টানে না ভেজার জন্য। শরতের সুনীল আকাশ ও কাশফুল আমার কাছে মনে হয় জড়। কোকিলের কালোর স্নিগ্ধতা মনে হয় বিবর্ণ। শুনেছি আমার সাথে সম্পকচ্ছেদের কিছুদিন পরই সে নিজের ইচ্ছাতেই বিয়ে করেছে। অবশ্যই ভাল করেছে। তবুও শীতের এই রাতে তাকে নিয়ে অথবা আমাদের জীবনের ঝরে পড়া গল্পটি লিখছি কেন জানি না। হয়তো আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমার অপেক্ষা এখনও সেদিনের, যেদিন সে ফিরে আসবে আবার। তারপর ঝুম বৃষ্টিতে আমার হাত ধরে মিলিয়ে দেবে শত উপেক্ষা। কোকিলের ডানায় ভর করে আমরা উড়ে বেড়াবো শরতের আকাশে। জানি, আমি এমন এক অপেক্ষায় যার কোন শেষ নেই। তবু অবুঝ মন অপেক্ষা করে যায় অণুক্ষণ..........

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন